‘’ কলঙ্কিনী রাধা আর বাংলা ভাষা ‘’
- ইত্যাদি ব্লগ
- Jul 5, 2020
- 3 min read
Updated: Jul 23, 2020
পিঙ্গলা পাণ্ডে ভট্টাচার্য
ও কিও কলঙ্কিনী রাধা
মাই হে জল এ না যাইও কদম গাছে বসিয়া আছে
কানু হারামজাদা।।
নেটফ্লিক্সে সম্প্রতি রিলিজ হয়েছে ‘বুলবুল’ ওয়েব সিরিজ। অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত ছবিটি সমালোচক ও দর্শকদের বাহবা পেলেও, ছবিতে ব্যবহৃত জনপ্রিয় বাংলা লোকগীতিটি নিয়ে প্রবল বিতর্ক ঘনিয়েছে । তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা এই গান শুনে খুব উত্তেজিত, তাদের রাগ ভগবান শ্রী কৃষ্ণ আর শ্রী রাধা সম্বন্ধে কটূক্তি করা হয়েছে। যার জেরে ডাক উঠেছে বুলবুল সিনেমা তথা নেটফ্লিক্স বয়কট করারও। অনুষ্কা শর্মাও আক্রমণের মুখে। আর শুরু হয়েছে বাংলা ভাষাকে কুরুচিকর আক্রমণ।
অভিযোগকারীদের দাবি, ওই বাংলা গানে হিন্দুদের ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে ‘হারামজাদা’ এবং তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রী রাধাকে ‘কলঙ্কিনী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা হিন্দুত্বের উপর আক্রমণ হিসেবেই দেখছেন অনেকে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট এ এই বহুল প্রচলিত ‘কলঙ্কিনী রাধা’ গানটি বাংলাদেশের সিলেটের বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিমের বলে উল্লেখ করছেন, যদিও এটি তাঁর লেখা গান নয়। ।খুব সন্তর্পণে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক মদতপুস্ত নেট দুনিয়া ব্যাপারটিকে একজন ‘মুসলমান’ কবি র লেখা হিন্দু ভগবান কে গালিগালাজ আর অপমান ইত্যাদি বলে প্রচার করা শুরু করে দিয়েছে।
একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার নিজের চ্যানেলে প্রশ্ন তোলেন, “এই মুভিতে যেভাবে হিন্দু দেব দেবীদের গালিগালাজ করা হয়েছে, সেটা কি বাংলায় খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা না কি? আমি ভুল করলে বাঙালিরা আমাকে শুধরে দেবেন!” পাশাপাশি তিনি চ্যালেঞ্জের ঢঙে প্রশ্ন তোলেন, নবী মহম্মদ বা যীশুকে এই ভাবে ডাকার ক্ষমতা কারও আছে কিনা। সেইসঙ্গে বুলবুলে ব্যবহৃত গানটিকে ‘সিলেক্টিভ সেকুলারিজম’-এর পরিচায়ক বলেও দাবি করেন তিনি।
বস্তুত, বাউলদের মুখে পরিচিত এই লোকগান বহুদিন ধরেই জনপ্রিয়। খুব সম্ভবত, এই বহুল প্রচলিত গানটি বিখ্যাত লোক কবি রাধারামন দত্ত র লেখা একটি সিলেটী ধামালি লোকসঙ্গীত।
আলোচনার বিষয় কৃষ্ণ ও রাধিকা সম্পর্কে স্থূল শব্দের প্রয়গ। বিশেষ করে বাঙালিদের দেবতা সম্পর্কে এই ধরনের বিশেষণ মূল আপত্তির বিষয়।
এই বিষইটি নিয়ে প্রথমেই যেটা বলার সেটি হল বাংলা সাহিত্যে স্থুল শব্দের প্রয়োগ নতুন নয়। এর আগেও বহুবার এই ধরনের প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেছে। সেই ধারায় উল্লেখ্য ‘বড়ু চণ্ডী দাসের লেখা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য’। যদিও এই কাব্যটির স্থূলতা বহু আলোচিত, তবুও এর সাহিত্য গুণ অস্বীকার করা যায় না।
বাংলা সাহিত্যর একটি বিশেষ শাখা পদাবলী সাহিত্য। রাধা কৃষ্ণ প্রেম যার উপজীব্য। এই ধরাটি পরবর্তী বাংলা সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' বা পদাবলী দুই ক্ষেত্রেই কৃষ্ণ চরিত্রের মধুর রসকেই বাংলায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে ভাগবতের দুটি ধারা, একটি উত্তর ভারতীয় যেখানে কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। তার চরিত্রের বীর রসই এই ধারায় প্রধান। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতীয় ধারা, যেখানে কৃষ্ণ বহু গোপিনী পরিবেষ্টিত গোপালক। আমাদের বাংলাদেশে, কবি জয়দেব এর গীতগোবিন্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী তে কবি বিদ্যাপতি সবক্ষেত্রেই কৃষ্ণ চরিত্রের মধুর রস তথা রাধাকৃষ্ণের প্রেমই প্রধান হয়েছে।
আর একটি বিষয়, বাংলা সাহিত্যের ধারাটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সাহিত্যের মূল ধারা গুলির পাশাপাশি একটি অপ্রধান ধারা সমানভাবে চলে আসছে, সেটি ‘লোক সাহিত্যের ধারা’। প্রাচীন কাল থেকেই ধারাটি, প্রান্তিক বিশেষ বিশেষ অঞ্চল ভেদে সেই সব অঞ্চলের মানুষের দ্বারা ব্যাক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত সাহিত্য।
যেমন বাউল, মুর্শিদি, কবিগান, টপ্পা, খেউর - এই সমস্ত শাখাতে বিভিন্ন সময় গ্রাম্য স্থূল শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
আর এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, আমরা বাঙালিরা দেবতাকে দেবতা থাকতে দিইনি কখনো, সব ক্ষেত্রেই তাকে আমাদের প্রতিদিন এর জীবনে নামিয়ে এনেছি। তা সে বৈষ্ণব পদাবলীর কৃষ্ণ আর রাধাই হোক, শাক্ত পদাবলী র উমা কিমবা শিবায়নের শিব। সবক্ষেত্রেই এঁরা আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
‘দেবতাকে প্রিয় করি
প্রিয়েরে দেবতা।‘
আর এটাই আমাদের বাঙালিদের প্রকৃতি।
দ্বিতীয়ত আর একটি বিষয় আমার মনে হয় আমরা বাঙালিরা ইউরোপীয় নবজাগরণের আলো যতটা প্রত্যক্ষ ভাবে পেয়েছি, ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের মানুষ ততটা পায়নি। আর তার এই আলো আমাদের সমাজ ভাবনা তথা ধর্ম ভাবনা কে অনেকটা ই প্রভাবিত করেছিল, যার প্রভাব আমাদের সাহিত্যেও পরেছে। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে দেবতার মানবিক রুপায়ন অনেক ক্ষেত্রেএই লক্ষ্য করা যায়। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা, বাঙালি ও অবাঙালিদের ধর্ম ভাবনায় একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য কোথাও যেন থেকে গেছে।
সুতরাং আমার মনে হয় গানটির শব্দ প্রয়োগ দেশের বাকি প্রদেশের মানুষ জন, বিশেষ করে স্বঘোষিত হিন্দু ধর্মের রক্ষাকর্তা দের কাছে আপাত স্থূল মনে হলেও আমাদের বাঙালিদের কাছে খুব অপরিচিত নয়। এখানে রচয়িতার মনোভাব নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ ধর্ম কে আঘাত করা নয়। বাস্তবোচিত শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা বা বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টাও বলা যেতে পারে যা বাংলায় নতুন নয়।
সুতরাং সোশ্যাল সাইটে কোন মন্তব্য করার আগে সামগ্রিক সামাজিক প্রেক্ষিতটা মাথায় রেখে করা উচিত। যে ধরনের মন্তব্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে, বা বিভেদকামিতাকে প্রশ্রয় দেয় তা না করাই শ্রেয়। আর আজকে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্ব যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমাদের আলোচনার মত আরও অনেক জ্বলন্ত সমস্যা আছে। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে সেই সব বিষয় থাকা উচিত যা আমাদের এই সামগ্রিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে।
সৌজন্য: Netflix You tube Wikipedia
Comments