চৈতন্য উদয়ে 'চৈতন্য'
- ইত্যাদি ব্লগ
- Jul 5, 2020
- 3 min read
Updated: Aug 11, 2020
পিঙ্গলা পাণ্ডে ভট্টাচার্য

'বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরিল কায়া'
ষোড়শ শতকের বাংলার নবজাগরণের পুরোধা শ্রী চৈতন্যদেব, এমন একজন বাক্তি-আধ্যাত্বিকতার মোড়কে যার ব্যাক্তিগত জীবন ও কর্মকাণ্ড অনেকটাই ঢাকা পরেছে। দেশ বিদেশের রেনেসাঁস তথা নবজাগরণ নিয়ে আমরা অনেক মাতামাতি করি। এখানে আমার এই ছোট্ট বাংলাদেশের নবজাগরণের পথিকৃৎ যিনি, স্বল্প পরিসরে তাঁরই জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করব।
শ্রী চৈতন্যদেব শুধুমাত্র যুগাবতার বা বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক নন। তিনিই প্রথম বাঙালিকে মানাবপ্রেমে দীক্ষিত করলেন। উচ্চ নীচ জাতিভেদ ভুলে শোনালেন সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বানী। অচ্ছুত অপাংক্তেয়কে বুকে টেনে নিলেন। ষোড়শ শতকের দ্বিধা বিভক্ত বাঙালিকে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন, ক্ষয়িষ্ণু ভাসমান বাঙালির চৈতন্যদয় ঘটালেন। শুরু হল 'চৈতন্য রেনেসাঁস'। যা বাঙালি চিরকাল স্মরণে রাখবে।
আনুমানিক ১২০৩ সাল। তুর্কী সম্রাট বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশের শাসন কর্তা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে নবদ্বীপ তথা বাংলাদেশ অধিকার করেন। শুরু হয় বাংলাদেশে তুর্কী শাসন। সেই সঙ্গে শুরু হয় ব্যাপক অরাজকতার – ধ্বংস হয় শিক্ষা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, চলে নরহত্যা, ধর্মান্তকরন।
এই ধর্মান্তর যে সব ক্ষেত্রেই জোরপূর্বক হয়েছিল তা নয়। হিন্দু সমাজের ছুৎমার্গ অস্পৃশ্যতা সেই সময়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তার উপর ছিল বর্ণভেদ প্রথা। সেই সময় সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কোন সামাজিক কাজকর্মের অধিকার ছিল না। একই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হলেও, যাবতীয় ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। সেই সময় নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের পূজাঅর্চনা বা শাস্ত্রপাঠেও কোন অধিকার ছিলনা। ফলে হিন্দু ধর্মের যাবতীয় সদর্থক দিকগুলো ছিল উচ্চবর্ণের জন্য, আর যার ফল ছিল সমাজের জন্য চূড়ান্ত নঞর্থক। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সমাজের উচ্চ আদর্শের সাথে পরিচিত ছিল না। ফলে তারা নানা প্রকার নীচ কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে সমাজকে কলুষিত করছিল। যার ফলে সমাজের উচ্চবর্ণের, তাদের প্রতি অবজ্ঞা আরও বৃদ্ধি পেল। আর অবজ্ঞাই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নিজধর্মের প্রতি আস্থাহীন ও বীতশ্রদ্ধ করে তুলল।
অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাব আর নানা প্রকার প্রলোভন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অন্য ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করল ও তারা ধর্মান্তরিত হল ।
ঠিক এই সময়, এই তমসাচ্ছন্ন বাংলাদেশে আবির্ভাব শ্রী চৈতন্যদেবের। জাতির চরম দুর্দিনে তিনি বিপর্যস্ত বাঙালিকে আলিঙ্গন করলেন। নবদ্বীপের শচীমাতার এই প্রবল দুরন্ত ছেলেটি অস্পৃশ্যতা ভেদে দ্বিধা বিভক্ত দুর্বল বাঙালিকে সংগঠিত করলেন এবং তুর্কী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মূলমন্ত্রটি শিখিয়ে দিলেন।
চৈতন্যদেব অবতার ছিলেন না, তাঁর কর্মই তাঁকে অবতার রূপে চিহ্নিত করল। তিনি যে শুধু হিন্দু সমাজের বর্ণভেদ প্রথা দূর করলেন তা নয়, তিনি যে মানব প্রেমের মন্ত্রে বাঙালিকে দীক্ষিত করলেন তা তুর্কী শাসকদেরও ছুঁয়ে গেল। চৈতন্য রেনেসাঁস যে কতখানি সুদূরপ্রসারী ছিল, ইতিহাসে তার প্রচুর প্রমাণ মেলে। চৈতন্যদেবের সময়ে তুর্কি সম্রাট হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ভাগবতের অনুবাদ হয়। শোনা যায় সম্রাট নাকি নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারতের পাঠ শুনতেন। অর্থাৎ মহাপ্রভুর মানব প্রেমের বানী হিন্দু সমাজের শুদ্ধিকরণের সাথে সাথে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বন্ধনটিও সুদৃঢ় করল।
শ্রী চৈতন্যদেব জন্মেছিলেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। আজ তাঁর জন্মের ৫৩৪ বছর পরে নতুন করে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধর্মান্ধতা, পরধর্ম বিদ্বেষ আজ আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিচ্ছে। এই ধর্মভেদ জাতি বিদ্বেষ আমাদের দুর্বল করে দেবে। আর তা বহিঃশত্রুর দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। ইতিহাসে তার সাক্ষ্য মেলে।
আমাদের এই ধর্মীয় অসম্প্রীতি ঠিক এইভাবে দৃষ্টি এড়াইনি ইংরেজদেরও। এই বিভেদের রন্ধ্রপথেই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ভারত বিভাগের পরিকল্পনা, যা সাময়িক ভাবে রদ করা গেলেও শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগ বন্ধ করা যায়নি। যার ফলশ্রুতি আজও দুঃস্বপ্নের মত আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
সুতরাং ধর্মের মেরুকরণ ও সর্বভারতীয় স্তরে ধর্মের রাজনীতিকরণ বন্ধ করতে হবে। আর এখানেই শ্রী চৈতন্য দেবের মতামত ও তাঁর দেখান দিশা নতুন করে আমাদেরকে পথ দেখাবে। আর তাই ‘কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী’ ও ‘রামনবমী’ পালনের পাশাপাশি চৈতন্যদেবের জন্মতিথিও একটি উৎসব হিসেবে পালন করতে হবে। চৈতন্যদেবের আদর্শ, তাঁর বানী জনমানসে প্রচার করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে সাম্প্রদায়িক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
এঁর জন্য আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীকে আরও বেশি তৎপর হয়ে ধর্মীয় উদারনীতির প্রচার করে, জনমানসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারণা বিস্তার করতে হবে। আর তখনই আমরা সকল ভারাতবাসী জাতিধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে আরো বেশী শক্তিশালী জাতিরুপে প্রতিষ্ঠা পাব।
আর তবেই হবে ভারাতবাসীর প্রকৃত চৈতন্যোদয়।।
Comments