স্মরণে মহাত্মা
- ইত্যাদি ব্লগ
- Oct 2, 2021
- 5 min read

----- পিঙ্গলা পাণ্ডে ভট্টাচার্য -----
একটি বছর চব্বিশের যুবক জীবনের গভীরতম সঙ্কল্প গ্রহণ করলেন একটি স্টেশনের প্লাটফর্মে। এইযুবক পেশায় ব্যারিস্টার।Durban থেকে Pretoria যাচ্ছিলেন একটি বিশেষ কাজে। রীতিমত First Class এর টিকিট কেটে বসেছেন।কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি যখন Pietermaritzburg স্টেশন পৌঁছায়, তখনই কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ ট্রেনের এই বিশেষ কামরাটিতে চড়ে এবং তাদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এই যুবককে জোর করে, রীতিমত ধাক্কা মেরে ট্রেন থেকে নীচে নামিয়ে দেয়।
এই যুবক আর কেউ নন, ‘The Father of our Nation’ – আমাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী।
১৮৬৯ গুজরাতের পোরবন্দরে জাত মোহনদাস রীতিমত ধনী পরিবারের সন্তান।বাবা ছিলেন রাজকোটের দেওয়ান। মাত্র ১৯ বছর বয়সে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে।
পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে ব্যারিস্টারিতে তেমন পসার করতে পারেন নি। আরএই সময়ই South Africa থেকে দাদা আবদুল্লার invitation এএকটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় South Africa পাড়ি দিলেন এই South Africa তেই তাঁর জীবনের দু একটি ঘটনা তাঁর জীবনভাবনা সম্পূর্ণ বদলে দিল।
বর্ণ বিদ্বেষ গান্ধীজীকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিল। ১৮৯৩ এ তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তার পরের বছর, ১৮৯৪ এ তিনি স্থাপন করলেন Natal Congress।১৯০৪ এ পত্রিকা সম্পাদনা করলেন Indian Opinion – লিখলেন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে।
এই আফ্রিকা তেই Durban এতিনি Phynix Farm স্থাপন করলেন।করলেন বিশ্বের প্রথম সত্যাগ্রহ। তিনি প্রথম জেলও গেলেন আফ্রিকাতেই।
গান্ধীজি যখন আফ্রিকাতে সেই সময় ভারতবর্ষের মত আফ্রিকা তেও ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ব্রিটিশ সরকার ভারতের দরিদ্র মজুরদের আফ্রিকায় আখের চাষের জন্য contract এপাঠায়।সেখানেও আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের দ্বারা চলে এই সমস্ত ভারতীয়দের প্রতি অমানবিক অত্যাচার। এইসমস্ত শ্রমিকদের রাত্রি ৯ টার পর ঘরের বাইরে বেড়োনো নিষেধ ছিল।তাদের পরিবারে কোনো Emergency হলেও এই নিয়ম বলবৎ ছিল।শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ সরকার খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য, আফ্রিকায় হিন্দুমতে বিবাহকে নিষিদ্ধ করে।শুধুমাত্র খ্রিস্টধর্মে বিয়েই গ্রাহ্য ছিল।মহাত্মা এই সমস্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান।আফ্রিকাতে বসেই লড়াই করেন আফ্রিকায় ব্রিটিশ নিপীড়িত ভারতীয় শ্রমিকদের জন্য। এই সময়ই গান্ধীজী সত্যাগ্রহকে হাতিয়ার করেন। Poll Tax ১৯০৯, ১৯১৩ তেও আন্দোলন করেন। পরবর্তী আন্দোলন গান্ধীজীর ১৯১৭, India-য়।
১৯১৩ এর পরে গান্ধীজী ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১৩, যে সত্যাগ্রহকে তাঁর আন্দোলনে হাতিয়ার করেছিলেন, ১১ বছর পর সেই আইন অমান্যই হয়ে উঠল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের তাঁর অন্যতম হাতিয়ার।
১৯০৯ তে আফ্রিকাতে থাকাকালীন ‘হিন্দ স্বরাজ’ বইটি লিখেছিলেন। এখানেই স্পষ্ট করেছিলেন যে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করার একমাত্র পথ হল তাদের সকল প্রকার প্রশাসনিক কার্যে ভারতীয়দের অসহযোগিতা, সকল সরকারি সংস্থা, কার্যপ্রণালীতে ভারতীয়দের সর্বতো অসহযোগিতা।
সুতরাং আফ্রিকায় গান্ধীজীর মহাত্মা হয়ে ওঠার পথটি তৈরী করে দিল, তৈরী করে দিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াই এর অন্যতম প্রধান জননেতা। গান্ধীজী নিজেও একসময় বলেছিলেন,
‘Gandhi was born in India but made in South Africa’.
এরপর শুরু হল ভারতে মোহনদাসের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই। যদিও সর্বক্ষেত্রেই তিনি অহিংসাকেই আন্দোলনের হাতিয়ার করলেন। গান্ধীজী ১৯৯৫ সালের ৯ই জানুয়ারি ২২ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। এই দিনটিকে এখন প্রবাসী ভারতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
দেশে এসে প্রথমেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। রাজনৈতিক গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলের পরামর্শ মতে প্রথমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখেন, দেশবাসীর মনের ইচ্ছে বোঝেন। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ দুই বছর তিনি দেশভ্রমণ করেন।
১৯১৭ তে তাঁর প্রথম আন্দোলন বিহারের চম্পরণে নীল চাষীদের সাথে মিলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের তিনকাঠী য়া নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং তিনি সফল হন। এটিই ছিল গান্ধীজীর ভারতে প্রথম সত্যাগ্রহ। এই আন্দোলনে সফলতার পরই পেলেন কবিগুরুর দেওয়া মহাত্মা উপাধি।
পরবর্তী আন্দোলন আমেদাবাদের কাপড় মিলের শ্রমিকদের জন্য। লড়লেন মিল মালিকদের বিরুদ্ধে। আদায় করলেন শ্রমিকদের জন্য যোগ্য প্লেগ বোনাস। করলেন ভারতবর্ষের হয়ে তাঁর প্রথম ভুখহরতাল। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন জনমানসের হিরো।
আমেদাবাদ থেকে গেলেন খেরাতে একই বছরে। খেরায় সে বছর কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জোর করে তাদের থেকে কর আদায় করছিল। গান্ধীজী এখানেও অহিংসা সত্যাগ্রহকে হাতিয়ার করে কৃষকদের কর মুকুব করলেন।
এরপরের আন্দোলনটি গান্ধীজীর গভীর জীবনদৃষ্টি উদার রাজনৈতিক মনের পরিচয় দেয়। তিনি তুর্কীতে ব্রিটিশ অত্যাচারিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়ে খিলাফত আন্দোলনে আলি বন্ধুদ্বয়ের সমর্থনে ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল ভারতীয়দের যোগদানের আহ্বান জানান। আশ্চর্যের বিষয় গান্ধীজী সর্বভারতীয় খিলাফত সমিতির সভাপতি মনোনীত হন। এই খিলাফত আন্দোলনের সাথেই ঘোষণা করলেন ১ লা আগস্ট ১৯২০, অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনেই ঘোষণা করলেন আত্মনির্ভর ভারতের। স্বাদেশী দ্রব্য ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। সর্বোপরি ব্রিটিশদের সাথে সর্বক্ষেত্রে সবরকম অসহযোগিতার। এইসময়ই রাষ্ট্রীয় শিক্ষার নীতি খুব বড়ভাবে সামনে এলো। যার পরিণতি ১৯৩৭ এ রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি। অসহযোগ আন্দোলন ১৯২২ পর্যন্ত চলেছিল। ১৯২২ এর ৫-ই ফেব্রুয়ারী চৌরিচোরার ঘটনার পর গান্ধীজী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন।
১৯৩০ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের উপর ছিল। ১৯৩০ সাল নাগাদ পুঁজিপতি সম্প্রদায়ও তাদের এই শোষণ নীতির কবলে পড়ে। এই সময়ই Young India নামক পত্রিকায় এই সকল শ্রেণীর সপক্ষে কথা বলতেন।করেছিলেন লবণ কর কম করার দাবী।
১৯৩০, ৫ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজী ১১ টি দাবী করে লর্ড আরউইনকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে এও জানান, দাবী না মানলে বড় মাপের আন্দোলনে নামবেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কোন দাবীই ব্রিটিশ সরকার মানেনি। পরিণতি ১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ আইন অমান্য আন্দোলন। সবরমতি আশ্রম থেকে ডান্ডি পর্যন্ত ২৪ দিনের পদযাত্রায় মাত্র ৭৮ জন অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পরে তাঁর এই অনুগামী লাখে বদলে গেছিল। আইন অমান্য চলাকালীন এক আমেরিকী সংবাদিক কে তিনি বলেছিলেন, ‘এই লড়াই শক্তির বিরুদ্ধে অধিকারের লড়াই, এবং আমি সমগ্র পৃথিবীর সহানুভূতি চাইছি’। ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত পদযাত্রা করে ৬ই এপ্রিল সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে তিনি ডান্ডিতে লবণ আইন অমান্য করার মধ্যে দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। গান্ধীজীর এই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এবং ব্রিটিশ সরকারের ভিত অনেকখানি নড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৩৭ এ কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে জহরলাল নেহেরু পূর্ণ স্বারাজের দাবি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের একাধিক হার সমগ্র বিশ্বে তাদের শক্তি হ্রাস করেছিল। সেই সময় ভারতেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চরমে পৌঁছয়। কংগ্রেস তার পূর্ণ স্বরাজের দাবি থেকে কোনমতেই সরছিল না। এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার পূর্ণ স্বারাজ না মানলেও Dominion Status এবং পরবর্তীতে ক্রিপস মিশনের মধ্যে দিয়ে নানা প্রকার শাসন সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কংগ্রেস তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। ব্রিটিশ সরকার পূর্ণ স্বারাজের দাবি না মানলে গান্ধীজী ১৯৪২ সালের ৪ই আগস্ট মুম্বাই এর গোয়ালিয়র ময়দানে একটি জনসভায় ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ র স্লোগান দেন। এইখানে তাঁর ৭২ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেন, এখনই দেশকে ব্রিটিশ শাসণ মুক্ত করতে হবে নইলে কোনদিনই নয়।
এইখানেই অহিংস গান্ধী প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে দেশের মুক্তির প্রয়োজনে হিংসার পক্ষপাত করলেন। তাঁর এই নির্দেশ দেশবাসীকে গভীরভাবে উজ্জীবিত করল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই দেশের প্রতিটি রাজপথ, প্রতিটি গলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সামিল হয়। গোটা দেশ তখন মুখরিত ‘ ইংরেজ ভারত ছাড়ার স্লোগানে। ৮ই আগষ্ট গান্ধী সহ দেশের অন্যান্য বড় রাজনৈতিক নেতারা বন্দী হন। গান্ধীজীকে নজরবন্দী করা হয় পুনের আগা খাঁ ফোর্টে। কোন বড় নেতা ছাড়াই আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলন হিংসাত্বক আকার ধারণ করলে, ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজীকে অনুরোধ করে আন্দোলন প্রত্যাহার করার। কিন্তু গান্ধীজী রাজী হন নি। আগস্ট আন্দোলন চলতে থাকে হিংসার পথেই। গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘’হিংসা ও কাপুরুষতা দুটোর মধ্যে কোন একটি যদি আমাকে নির্বাচন করতে হয়, তবে আমি হিংসাকেই নির্বাচন করব”।
এই আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের উৎখাতে একটি বড় ভূমিকা গ্রহণ করল। ব্রিটিশ সরকার বুঝল এদেশে আর তাদের শাসন দীর্ঘ স্থায়ী হবেনা। এবং ধীরে ধীরে তাঁরা ভারত ত্যাগের পরিকল্পনা গ্রহণ করল।
যে Pietermaritzburg স্টেশনে ট্রেন থেকে গান্ধীজী কে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ সেখানেই তাঁর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। আজকের দিনে ভারতীয়, অভারতীয় নির্বিশেষে সকলে তাঁর মূর্তিতে মাল্য দান করেন, এইখানেই তিনি ইতিহাস লিখলেন। ভারতের স্বাধীনতার লড়াই এ তিনি নিজেই একটি যুগ। এই যুগ স্রষ্টা শুধু ভারত ইতিহাসেই নয়, তাঁর বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী লড়াই সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তাঁকে স্বরনীয় করেছে। ভারতরাষ্ট্রের এই লড়াকু, তথা মানবতাবাদী জন নেতার জন্মদিনে তাঁর সংগ্রামী জীবন ও কর্মকাণ্ড কে সশ্রদ্ধ প্রণাম।
গান্ধীজীর ছবিটি এঁকেছে রাজিতা পাণ্ডে,চতুর্থ র্শ্রেণী, বয়স নয়।
Comments